ঝমঝমিয়ে প্রথম বৃষ্টি । আজ আষাড়স্য প্রথম দিবসে বছরের প্রথম বৃষ্টি, সেই কত যুগ আগে কালিদাস-এর মেঘদূত কাব্যে যক্ষ মেঘকে জানিয়েছিল তার বার্তা প্রেমিকার কাছে পৌছে দেওয়ার আর্জি। তারপর কত যুগ কেটে গেছে, বৃষ্টি কিন্তু পুরোনো হয়নি , আজও সে নির্মল নবীন ।
আজ সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা, থমথমে গুমোট পরিবেশ, বাতাস বইছেনা । গত কয়েকদিন ধরে রোজ এই একই রকম চলছে । তাই রোজকার মিথ্যে প্রলোভনে ভুলে আজ আশা করতেও ভয় লাগছিল যে বৃষ্টি হতে পারে । সন্ধের পর থেকে ঝোড়ো হাওয়া যদিও সেই লোভের সলতে তাকে আরেকটু এগিয়ে দিল ।
হঠাৎ শুরু হলো আমাদের আবহাওয়া অফিসের ভাষায় যাকে বলে বজ্র- বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত।
বছরের প্রথম বৃষ্টি, হয়ত বর্ষা এসেই গেল। ছোটবেলায় জানতাম জুনের প্রথম সপ্তাহের পরেই বর্ষা আসে, কিন্তু প্রত্যেক বছর বর্ষা যেন আরো বিলম্বিত হয়ে আসছে । আজ শুরু হলো ঝোড়ো হাওয়া দিয়ে, তারপর দেখলাম হাওয়ায় জলের বিন্দু ভেসে আসছে. তারপর শুরু হলো বৃষ্টি। গত কদিনের প্রচন্ড দাবদাহের পর একটু স্বস্তি । জানালার ধরে দাঁড়িয়েছিলাম, বৃষ্টির ছিটে এসে মুখে লাগছিল। প্রথম বৃষ্টি, তার মত স্বস্তিদায়ী, তার মত স্নিগ্ধ, জানিনা পৃথিবীতে আর কিছু আছে কিনা.. বিজ্ঞানের ভাষায় বলে প্রথম বৃষ্টি দূষিত, বাতাসের কিছু বিষাক্ত গাস, ধুলিকণা এইসব ধুয়ে সাথে নিয়ে প্রথম বৃষ্টি নামে.. আমার ভাবতে বয়েই গেছে.. শুধু চোখ বন্ধ করে জানালার সামনে বৃষ্টির ছিটে মুখের ওপর নিয়ে দাড়িয়ে থাকা, জীবনের কোনো না কোনো মুহুর্তে এই ছেলেমানুষীটা হয়ত প্রত্যেকেই করে.. ওই ঠান্ডা হাওয়ায় ভেজা প্রথম বৃষ্টি, সাথে করে কত যেন স্মৃতি বয়ে আনে। সেই প্রথম প্রেম, যার সাথে প্রথম দেখা এমনি এক বৃষ্টির দিনে.. পরীক্ষায় জীবনের সবথেকে ভালো রেজাল্ট.. জানতে পারলাম আবার এক বৃষ্টির দিনে.. কলেজের প্রথম দিন.. সেদিনও বৃষ্টি.. আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য মুহূর্তগুলো যেন বৃষ্টিময়। সকালে ঘুম থেকে উঠে মেঘলা আকাশ দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়.. আর সেই আকাশ থেকেই যখন বৃষ্টি পড়তে সুরু করে,,, কোন এক ম্যাজিকে সেই সব মনখারাপ নিমেষে উধাও..
আর সমুদ্র সৈকতে প্রথম বৃষ্টি, কেবলমাত্র যে দেখেছে .. সেই জানে তার কি অসামান্য রূপ.. . সে যে কত রোমাঞ্চকর দৃশ্য.. চরাচর বিস্তৃত কালো মেঘ, সমুদ্রের জলে সেই মেঘের ছায়া.. তারপর প্রবল বেগে বৃষ্টির আঘাত সমুদ্রের জলে.. সামনে উত্তাল সমুদ্র.. যতদূর অব্দি চোখ যায়.. শুধু বৃষ্টি.. বৃষ্টি.. আর বৃষ্টি..
এ তো গেল প্রথম বৃষ্টির গল্প.. এবার পুরো বর্ষাকালের বৃষ্টির কথায় আসা যাক..বৃষ্টি বললেই প্রথম মনে আসে খিচুড়ি.. তার আগে বিকেলে পকোড়া আর আদা চা দিয়ে আড্ডা । আর সেখানে কেউ যদি ভূতের গল্প বলতে পারে, তাহলে সেদিনের আড্ডার সেই মধ্যমনি..আরো এক প্রস্থ চা-এর পর রাতে খিচুড়ি আর ডিমভাজা।
ছোটবেলায় প্রচন্ড গরমের পর যেই বৃষ্টি শুরু হত.. কারোর কোনো বাধা নিষেধ না মেনে একছুটে আমি আর আমার ছোট ভাই বাড়ির বাইরে.. বাবা বকছে, মা ডাকছে, কিন্তু কে শোনে কার কথা.. বকাবকি তো বাড়ির ভেতর থেকেই চলবে.. কেউ তো আর বাইরে বেরিয়ে আসছে না আমাদের নিয়ে যেতে। বড়রা বৃষ্টিতে ভেজার আগে হাজাররকম চিন্তা করে.. ভিজে গেলে সর্দি হবে, কাল অফিস আছে. জ্বর এসে গেলে চাকরিতে কামাই, এখন আমরা বড় হয়ে গিয়ে যেমন ভাবি । কিন্তু তখন ছোটবেলায় অত কথা কে ভাবে? বৃষ্টি এসেছে, অতএব ভিজতে হবে। বৃষ্টির নামের আবার কত রকমফের । টিপটিপ বৃষ্টি, ঝমঝম বৃষ্টি, ইলশে-গুঁড়ি বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, ঝড় আর বৃষ্টি.. বড় হওয়ার সাথে সাথে বৃষ্টির ওই রূপগুলো বদলে যায়।
কলকাতা শহরে বৃষ্টি আনন্দের যদি সারাদিন বাড়িতেই বসে থাকতে হয় । বেরোতে হলে তা বড় যন্ত্রণার ব্যাপার । অল্প হলে ভালো, কিন্তু বৃষ্টি যত বাড়বে, রাস্তায় জল দাড়াবে, ঢেউ তুলে বাস ট্যাক্সি গুলো যাতায়াত করবে, যেন মহানগরেই সমুদ্রের আভাস । বাড়ির সামনে হাঁটুজল.. বাড়ি থেকে যাওয়া আসা সেই আবর্জনা ভর্তি নোংরা জলে পা ডুবিয়ে.. প্রত্যেক বছর সেই একই অবস্থা.. সবার প্রতিশ্রুতির বন্যা.. কিন্তু অবস্থা ন যযৌঃ না তস্থঊঃ । যাইহোক অনেক আষাঢ়ে গল্প হলো.. রান্নাঘর থেকে পকোড়ার গন্ধ আসছে.. আজ এখানেই থাক.. আবার একদিন গল্প করা যাবে।
No comments:
Post a Comment